ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়া উপজেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান পদ নিয়ে ধুম্রজাল!

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মকছুদুল হক ছুট্টু ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান জেসি চৌধুরী পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান পদ নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। একজন উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় সিংহভাগ সদস্যের ভোটে নির্বাচিত হলেও পাঁচমাস পর অন্যজন মন্ত্রাণালয় থেকে জারিকৃত পরিপত্রের আলোকে একই পদে মনোনীত হয়েছেন।

উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভার সিদ্বান্তক্রমে উপজেলা পরিষদের ১নম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান নির্বাচনের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে দাবি করেছেন উপজেলা পরিসদের উন্নয়ন সভার সদস্য বেশির ভাগ ইউপি চেয়ারম্যান। এ অবস্থায় উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন সমন্বয় সভার কার্যক্রম ও সিদ্বান্ত বাস্তবায়নে এক ধরণের ধোঁয়াশা দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ইউপি চেয়ারম্যানরা।

এদিকে উপজেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান গঠন নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরীর ঘটনায় উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভার সিদ্বান্তের আলোকে ১নম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান নির্বাচন বলবৎ রাখার আবেদন জানিয়ে ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রানালয়ের সচিবের কাছে লিখিত আবেদন দাখিল করেছেন চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী। গত ৫ নভেম্বর স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রানালয়ে ৫৬ নম্বর স্বারকমুলে আবেদনটি জমা দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, চকরিয়া উপজেলা পরিষদের এক নম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান পদে উপজেলা পরিষদ উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সদস্যদের ভোটে প্রথমে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মকছুদুল হক ছুট্ট নির্বাচিত হলেও পাঁচমাস পর একই পদে নিযুক্ত হয়েছেন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান জেসমিন হক জেসি চৌধুরী। গত ৩০ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগের উপজেলা-১ শাখা উপ-সচিব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত পত্রদ্বারা চেয়ারম্যান প্যানেল গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।

অপরদিকে উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে ১৩জন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের প্রস্তাবিত ভোটে পাঁচমাস আগে উপজেলা পরিষদের এক নম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন ভাইস চেয়ারম্যান মকছুদুল হক ছুট্ট। সেই আলোকে গত ২৪ জুন অনুষ্ঠিত চকরিয়া উপজেলা পরিষদের জুন/১৯ মাসের উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভার ১নং অনুচ্ছেদের সিদ্ধান্তের আলোকে মকছুদুল হক ছুট্ট এক নম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার বিষয়টি নিশ্চিত করে পরবর্তী প্রদক্ষেপ গ্রহনের জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্মারক নং : ০৫.২০.২২১৬.০০৩.০৫.০৫.২০১৯ মুলে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রাণালয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগে লিখিত পত্র প্রেরণ করেন চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুদ্দিন মুহাম্মদ শিবলী নোমান।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রানালয়ে পাঠানো পত্রে তুলে ধরা হয়েছে ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ চকরিয়া উপজেলায় পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ী চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানের ৪ এপ্রিল এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের গেজেট প্রকাশিত হয় ২১ এপ্রিল। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের নির্দেশনার আলোকে ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ সম্মেলন কক্ষে চকরিয়া উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্যগণের শপথ গ্রহন হয়েছে।

পত্রে উল্লেখ্য করা হয়েছে, তৎপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ৮ মে চকরিয়া পঞ্চম উপজেলা পরিষদের প্রথম উপজেলা পরিষদ উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির মাসিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। মে/১৯ মাসের উপজেলা পরিষদ উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভার ৩নং সিদ্ধান্তে উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ (১৯৯৮ সনের ২৪নং আইন)-এর ১৫(১) ধারা অনুযায়ী নবনির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যানগণ তাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এক মাসের মধ্যে দুই সদস্য বিশিষ্ট চেয়ারম্যান প্যানেল গঠন করে সভাকে অবহিত করার জন্য বলা হয়। পরবর্তীতে প্রথম সভার ৪৮দিন পর উপজেলা পরিষদ উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির জুন/১৯ মাসিক সভায় ভাইস চেয়ারম্যানদ্বয় হতে প্যানেল চেয়ারম্যান গঠনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ভাইস চেয়ারম্যানদ্বয় উভয়ে প্যানেল চেয়ারম্যান-১ হওয়ার ইচ্ছ পোষণ করেন। তবে পরবর্তীতে তাঁরা নিজেদের মধ্যে একমতে পৌঁছাতে পারেনি মর্মে সভাকে জানান।

মন্ত্রাণালয়ে পাঠানো পত্রে উপজেলা পরিষদের সভার মুখ্য কর্মকর্তা ইউএনও শিবলী নোমান বলেন, জুন/১৯ মাসের উপজেলা পরিষদ উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় সভাপতি (উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান) ভাইস চেয়ারম্যানদ্বয় প্যানেল চেয়ারম্যান গঠনে একমত হতে না পারায় একই আইনের ১৫(৪) ধারা অনুযায়ী অথবা পরিষদের সদস্যগণের মতামতের ভিত্তিতে উপস্থিত সদস্যগণকে চেয়ারম্যান প্যানেল গঠনের বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য অনুরোধ করেন।

ওইদিনের সভায় চকরিয়া উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৫জন ইউপি চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে থেকে উপস্থিত ১৩ জন ইউপি চেয়ারম্যান যথাক্রমে চিরিংগা জসীম উদ্দিন, সাহারবিল মহসিন বাবুল, বরইতলী জালাল আহমদ সিকদার, বিএমচর এসএম জাহাঙ্গীর আলম, ডুলাহাজারা মো.নুরুল আমিন, হারবাং মিরানুল ইসলাম মিরান, খুটাখালী মো.আবদুর রহমান, বমুবিলছড়ি আবদুল মতলব, ঢেমুশিয়া নুরুল আলম জিকু, বদরখালী খাইরুল বশর, কৈয়ারবিল মক্কী ইকবাল হোসেন, পূর্ববড় ভেওলা আনোয়ারুল আরিফ দুলাল এবং লক্ষ্যারচর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তাফা কাইছার সভায় উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানকে মকছুদুল হক চুট্টুকে প্যানেল চেয়ারম্যান-১ করার জন্য মতামত দেন।

একই সঙ্গে সভায় উপস্থিত কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত ওসমান ও কোনাখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দিদারুল হক সিকদার সভায় বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং উপজেলা চেয়ারম্যান উভয়ে আলোচনার মাধ্যমে প্যানেল চেয়ারম্যান গঠনের পক্ষে মতামত প্রদান করেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন না উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সদস্য চকরিয়া পৌরসভার মেয়র এবং ফাঁসিয়াখালী, সুরাজপুর-মানিকপুর ও পশ্চিম বড় ভেওলা ইউপি চেয়ারম্যান। সেই কারণে তাঁদের মতামত পাওয়া যায়নি। মন্ত্রাণালয়ে প্রেরিত পত্রে বলা হয়েছে, উপজেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যগণের মতামতের ভিত্তিতে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মকছুদুল হক ছুট্টুকে প্যানেল চেয়ারম্যান-১ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান জেসমিন হক জেসিকে প্যানেল চেয়ারম্যান-২ করে চেয়ারম্যান প্যানেল গঠন করার জন্য জুন/১৯ মাসের উপজেলা পরিষদ উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়। অন্যদিকে উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় অনুপস্থিত সুরাজপুর-মানিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, উপজেলার সিংহভাগ ইউপি চেয়ারম্যান মকছুদুল হক ছুট্টকে সমর্থন দিয়েছেন। সভার উপস্থিতি সমর্থনকে আমিও সমর্থন জানাই। চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, বিধিমালা মোতাবেক উপজেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান নির্বাচন সম্পন্ন করতে প্রথমে দুই ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্ঠা করা হয়। দুইজনই উল্লেখিত পদে আসতে আগ্রহী হওয়ায় আমরা ভোটের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নিই।

তিনি বলেন, পরবর্তীতে গত জুন মাসে উপজেলা পরিষদের মাসিক উন্নয়ন সমন্বয় সভায় বিষয়টির আলোকে উম্মুক্ত আলোচনার সুযোগ দেয়া হয়। ওইসময় উপজেলা পরিষদের সদস্য ১৮টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মধ্যে ১৫ জন চেয়ারম্যান সভায় উপস্থিত ছিলেন। ওইদিন সভায় উপস্থিত ১৩ জন ইউপি চেয়ারম্যান উপজেলা পরিষদের ১নম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান পদে মকছুদুল হক ছুট্টোকে সমর্থন দেন। এ সংক্রান্ত সভার রেজুলেশন কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রানালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। সেখানে মন্ত্রানালয় থেকে নতুন করে পরিপত্র জারির সুযোগ নেই।

বিষয়টি প্রসঙ্গে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুদ্দিন মুহাম্মদ শিবলী নোমান বলেন, উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় প্যানেল চেয়ারম্যান-১ গঠনের বিষয়টি লেজুরেশন সহকারে জেলা প্রশাসকের দপ্তর হয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রাণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রানালয়ে পাঠাতে হলে বিষয়টি নির্বাচিত পরিষদের প্রথম সভার পরপর পাঠাতে হতো।

তিনি বলেন, দুইপক্ষের সমঝোতা ও মতানৈক্যের কারণে সভা হয়েছে পরে। ফলে সেটি পাঠাতে হয়েছে একমাস পর। স্থানীয়ভাবে সমাধান না হলে বিষয়টি মন্ত্রানালয়ের এখতিয়ারভুক্ত।

উল্লেখিত বিষয়ে চকরিয়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান জেসমিন হক জেসি চৌধুরী বলেন, ইতোপুর্বে গঠিত প্যানেল চেয়ারম্যান নির্বাচন উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ (১৯৯৮ সনের ২৪নং আইন) এর ধারা ১৫ (১) অনুসারে করা হয়নি। সেই কারণে একই আইনের ধারা ১৫ (৫) অনুসারে সরকার কর্তৃক চেয়ারম্যান প্যানেল গঠন করা হয়েছে। সেখানে আমাকে প্যানেল চেয়ারম্যান-১ মনোনীত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমাকে এক নম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান মনোনীত করার বিষয়টি নীতিমালার আলোকে হয়েছে। সুতারাং এই নিয়ে বিভ্রান্তির কোন সুযোগ নেই।

পাঠকের মতামত: